
নোবেল পুরস্কার সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক পুরষ্কার। সম্মান, মর্যাদা এবং উল্লেখযোগ্য পুরষ্কারের অর্থ ছাড়াও, প্রাপক একটি স্বর্ণপদকও পান যার মাধ্যমে এই পুরষ্কার প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেল (১৮৩৩ – ১৮৯৬) কে স্মরণ করা হয়। প্রতি বছর এটি রসায়ন, সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসা, অর্থনীতি এবং শান্তি বিভাগে বিজ্ঞানী এবং পণ্ডিতদের দেওয়া হয়। এখানে আমরা কয়েকটি নোবেল পুরস্কার বা তার বিজেতা সম্পর্কে জানব ও উদ্বুদ্ধ হব।
নোবেল জয়ীদের কথা: ৪ টি পুরস্কার সম্পর্কে
1. জোসলিন বেল বার্নেল

আজ পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের বেক্তিদের মধ্যে ৮ শতাংশেরও কম ছিলেন মহিলা, যা থেকে কেউ কেউ দাবি করেন যে পুরস্কার কমিটি মহিলাদের উপেক্ষা করেছেন বা করেন। এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত একটি অভিযোগ হলো জোসলিন বেল বার্নেলের প্রতি অবিচার। তিনি ১৯৬৭ সালে পালসার আবিষ্কার করেন এবং পরে তার উপদেষ্টা অ্যান্টনি হুইশের সাথে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র অ্যান্টনি হুইশ এবং আরেক সহকর্মী মার্টিন রাইলকে ১৯৭৪ সালে পালসার আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: নিকোলা টেসলা – যাঁর আবিষ্কারগুলি আধুনিক সভ্যতার স্তম্ভ
2. নোবেল দেওয়া হলো শুধু একটা বিক্রিয়ার জন্য

১৯৯৫ সালে কেমিস্ট্রির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো শুধু একটা বিক্রিয়ার জন্য! হ্যাঁ, ওজোন গ্যাস আর ক্লোরিনের বিক্রিয়া। বিক্রিয়াটি হয়তো অনেকে পড়েও থাকবে । এটা দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে “কেবল, এইটুকুর জন্য আবার নোবেল পুরস্কার ?”
কিন্তু কাজটা মোটেও সোজা ছিল না। তখনকার দিনে কম্পিউটার মানে আজকের মত AI বা Simalation software ছিল না। সেই সময়ে উপরের স্তরের বায়ুমণ্ডলে (stratosphere) কী হচ্ছে সেটা বোঝা তো দূরের কথা, ওখানে ক্লোরিন কেমন করে ওজোন ধ্বংস করে, সেটা কল্পনাই ছিল দুরূহ।
Paul Crutzen, Mario Molina, আর Frank Sherwood Rowland—এই তিনজন বিজ্ঞানী মাথার খাঁটনি দিয়ে (সরাসরি বললে, পেন-কাগজ নিয়ে বসে) দেখালেন যে CFC (chlorofluorocarbon) থেকে বের হওয়া ক্লোরিন কীভাবে একটা একটা করে ওজোন অণুকে ভেঙে ফেলছে। শুধু ভাঙেই না—একটা ক্লোরিন অণু হাজার হাজার ওজোন ধ্বংস করতে পারে, একটা চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে।
এটাকে অনেকেই মনে করতেন একটা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার বিপদ সংকেত ! কারণ, তখনো কেউ জানতো না যে স্প্রে ক্যান বা ফ্রিজের ভেতর থাকা গ্যাস একদিন আকাশের রং বদলে দেবে। কিন্তু এই তিনজন সেই অদৃশ্য বিপদের গন্ধ পেয়েছিলেন। গবেষণা করলেন, মানুষকে সচেতন করলেন, এবং পৃথিবীকে একটা বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলেন।
ওই একটা বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্যই আজকে আমরা জানি যে ওজোন লেয়ার রক্ষা কতটা জরুরি। এবং সরকারিভাবে CFC নিষিদ্ধ করার পেছনে এই গবেষণাই ছিল সবচেয়ে বড় কারণ।
একটা ছোট রাসায়নিক বিক্রিয়া, একটা ছোট রাডিক্যাল আর একটা গভীর বোঝাপড়া—এই তিন মিলে রক্ষা পেয়েছে একটা আস্ত গ্রহের পরিবেশ।
পড়ে দেখুন: বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক আয়না কি, কোথায়
3. জন ফোর্বস ন্যাশ জুনিয়রের অর্থনীতিতে নোবেল

গণিতবিদ জন ফোর্বস ন্যাশ জুনিয়রকে গেম থিওরিতে তার কাজের জন্য (১৯৯৪ সালে) অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। তিনি ‘ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম’ নামক একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারণার জন্য পরিচিত।
ত্রিশের কোঠায় থাকাকালীন ন্যাশের প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে এবং তাকে বেশ কিছু সময় চিকিৎসাকেন্দ্রে থাকতে হয়েছিল। সিলভিয়া নাসারের একই নামের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড‘ মুক্তির পর তার কাহিনীটি খ্যাতি লাভ করে।
জন ফোর্বস ন্যাশ, জুনিয়র প্রথমে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করলেও, পরে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকায় যোগ দেন। মানসিক অসুস্থতার মুখে ন্যাশের দৃঢ়তা তাকে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে। তার গল্প স্কিৎজোফ্রেনিয়ার সাথে জড়িত অন্যায্য কলঙ্কের ঊর্ধ্বে উঠে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির কৃতিত্বকে সাধুবাদ জানাতে মানুষকে উৎসাহিত করে।
4. অ্যারন সিচানোভার – রসায়নে নোবেল ২০০৪

অ্যারন সিচানোভার যুদ্ধবিধ্বস্ত ইজরায়েলে বড় হয়েছেন এবং নিজেকে একসময়কার কিশোর অপরাধী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনাথ হওয়ার পর তার বড় ভাই জোসেফ তাকে বড় করেন এবং তার কিশোরসুলভ আচরণ ত্যাগ করে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করেন। অ্যারন ১৮ বছর বয়সে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন এবং একই সাথে তার বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবাও সম্পন্ন করেন। ১৯৭৩ সালে স্নাতক হওয়ার কিছুদিন পরেই, অ্যারন ইয়োম কিপুর যুদ্ধে নৌবাহিনীর সার্জন হিসেবে আহতদের অস্ত্রোপচার করেন। অনেককে অবাক করে দিয়ে, যুদ্ধের মাত্র ছয় মাস পরে অ্যারন তার সার্জনের পেশা ছেড়ে দেন। একজন গবেষক হিসেবে, তিনি একটি অজনপ্রিয় বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেন: শরীর কীভাবে তার অপ্রয়োজনীয় প্রোটিনগুলো নিষ্কাশন করে।
অ্যারন শরীরের ‘আবর্জনা-সংগ্রহ ব্যবস্থা’ হিসেবে যা বর্ণনা করেছেন তার উপর মনোনিবেশ করেন। তিনি এবং তার গবেষণা সহযোগী আরউইন রোজ ও আব্রাম হার্শকো আবিষ্কার করেন যে কীভাবে ‘ইউবিকুইটিন’ নামক একটি পরিচিত প্রোটিন অণু ব্যবহৃত প্রোটিনগুলোর ধ্বংস নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রক্রিয়াটি ছাড়া শরীরে প্রদাহ, স্নায়বিক ও পেশী সংক্রান্ত রোগ, এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
প্রাক্তন সার্জন অ্যারন সিচানোভারের জৈব রাসায়নিক আবিষ্কারগুলো তাকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। সিচানোভারের কাজ ক্যান্সার-রোধী ওষুধের বিকাশের মতো বাস্তব প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সেই পথটি এমন সব আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত করেছে যা মানব শারীরবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও গভীর করে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি করার সম্ভাবনা রাখে।