নিকোলা টেসলা: যাঁর আবিষ্কারগুলি ছাড়া আধুনিক সভ্যতা অকল্পনীয়

নিকোলা টেসলা
চিত্র সৌজন্য

নিকোলা টেসলা যদি জন্মগ্রহণ না করতেন তবে আধুনিক জীবনের অনেক সুবিধাই হয়ত আজ অধরা থাকত, যেমন আলো, যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ আমাদের আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা রয়েছে নিরাপদ, দক্ষ এবং সাশ্রয়ী মূল্যের অ্যালটারনেটিং কারেন্ট (AC) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর। একইভাবে, যদি না থাকত Wi-Fi, রেডিও, রিমোট কন্ট্রোল বা রোবোটিক্স, তাহলে আমাদের পৃথিবী ঠিক কেমন হতো? এসব অসাধারণ আবিষ্কারের পেছনে রয়েছেন ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদী: নিকোলা টেসলা

মাত্র ছয় বছর বয়সে নিকোলা টেসলা তাঁর আবিষ্কারের যাত্রা শুরু করেন। প্রকৃতির প্রতি গভীর আগ্রহ, বুদ্ধিমত্তা ও কৌতূহলের মিশ্রণে তিনি ছোটবেলায় তৈরি করেন জুনবাগ চালিত মোটর, এয়ার পিস্টন বন্দুক এবং ব্যাঙ ধরার যন্ত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তিনি জলচালিত টারবাইন তৈরি করেন এবং তখনই স্বপ্ন দেখেন নাইয়াগ্রা জলপ্রপাত ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের — একটি স্বপ্ন, যা বাস্তবে রূপ পায় ১৮৯৬ সালে।

যৌবনে টেসলা গণিত, পদার্থবিদ্যা, প্রকৌশল ও বিজ্ঞানে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর প্রথম দিককার একটি চাকরি ছিল বুদাপেস্ট টেলিফোন এক্সচেঞ্জে, যেখানে তিনি যন্ত্রপাতির উন্নতি ঘটান এবং একটি অ্যাম্পলিফায়ার তৈরি করেন। এরপর প্যারিসে আরেকটি চাকরিতে কাজ করার সময় তিনি এডিসনের ডায়নামোর উন্নয়ন সাধন করেন এবং একটি স্বয়ংক্রিয় রেগুলেটর তৈরি করেন।

১৮৮৪ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে নিকোলা টেসলা আমেরিকায় পা রাখেন এবং ১৮৮৮ সালে তাঁর প্রথম পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন। এরপর তিনি একের পর এক নতুন আবিষ্কার করতে থাকেন এবং ১৯৪৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি পেটেন্ট অর্জন করেন। মানবকল্যাণের জন্য প্রকৃতির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রতি তাঁর আজীবন প্রতিশ্রুতি আজও বিশ্বকে উপকৃত করে চলেছে।

পড়ে দেখুন: আলবার্ট আইনস্টাইনের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও বিজ্ঞান জগতে তার প্রভাব

নিকোলা টেসলার প্রথম জীবন

নিকোলা টেসলা ১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের স্মিলজানে জন্মগ্রহণ করেন, বর্তমানে যার নাম ক্রোয়েশিয়া। তাঁর বাবা, মিলুটিন টেসলা ছিলেন একজন সার্বিয়ান অর্থোডক্স যাজক এবং তাঁর মা, জুকা ম্যান্ডিচ, ছিলেন গৃহস্থালীর সরঞ্জাম উদ্ভাবক।

কলেজে পড়ার সময় টেসলা প্রথমে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত পড়তে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই তিনি বিদ্যুতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ১৮৭৩ সালে কার্লস্ট্যাডের রিয়ালশুলে, অস্ট্রিয়ার গ্রাজের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৮৮১ সালে বুদাপেস্টে একটি টেলিফোন কোম্পানিতে তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে তিনি চাকরি পান।

ইন্ডাকশন মোটরের ধারণা

১৮৮৩ সালে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে থাকাকালীন এক বন্ধুর সাথে পার্কে হাঁটার সময় তিনি ইন্ডাকশন মোটরের ( অর্থাৎ তড়িৎ চৌম্বকীয় আবেশ দ্বারা চালিত একটি এসি মোটর) একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন এবং সফলভাবে পরীক্ষা করেন। যেহেতু তিনি ইউরোপে এটির প্রতি কারো আগ্রহ খুঁজে পাননি, তাই নিকোলা টেসলা নিউইয়র্কে টমাস এডিসনের সাথে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।

টেসলার নায়াগ্রা জলপ্রপাত ঘিরে স্বপ্ন

টেসলা যুবক বয়স থেকেই কল্পনা করতেন নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে শক্তি উত্পন্ন করা। ১৮৯৫ সালে, তিনি জলপ্রপাতে প্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ডিজাইন করেন, যা পরিবর্তী প্রবাহের বিজয় নিশ্চিত করে। পরবর্তীতে, তাঁর সম্মানে গোট দ্বীপে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।

টেসলার অদ্ভুত অভ্যাস

এত প্রতিভাময় টেসলা বেশ অদ্ভুত স্বভাবের ছিলেন যেমন :–

  • খাদ্যাভ্যাস: টেসলা মাংস খাওয়া পুরো ছেড়ে দিয়েছিলেন – এক পর্যায়ে কঠিন খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেন। তিনি উষ্ণ দুধ এবং আর্টিকোক ও সেলারির মতো সবজি দিয়ে তৈরি একটি পানীয় পান করতেন এবং মধু খেতেন।
  • ঘুমের অভ্যাস: তাঁর ঘুমের অভ্যাসও ছিল অস্বাভাবিক। তিনি বলতেন যে তিনি একবারে ২ ঘণ্টার বেশি ঘুমাননি। তবে, তিনি মাঝে মাঝে শরীরের “ব্যাটারি রিচার্জ” করার জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন। একটি প্রতিবেদন অনুসারে, তিনি একবার ৮৪ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে কাজ করেছিলেন।

টমাস এডিসনের সাথে মতানৈক্য

নিউ জার্সিতে টমাস আলভা এডিসনের ল্যাবে কাজ করার সময়, বৈদ্যুতিক প্রবাহের সর্বোত্তম রূপ নিয়ে তাঁর মতবিরোধ শুরু হয়। এডিসন ডিরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি (যা এক দিকে প্রবাহিত হয়)-এর পক্ষপাতি ছিলেন, যেখানে নিকোলা টেসলা পরিবর্তী প্রবাহ বা এসি (যা পর্যায়ক্রমে দিক পরিবর্তন করে)-এর পক্ষপাতী ছিলেন। এর ফলে ‘কারেন্টের যুদ্ধ’ শুরু হয়, যেখানে এসির বৃহত্তর দক্ষতার কারণে টেসলা জয়ী হন।

সারা আমেরিকা জুড়ে বিদ্যুত পৌছে দিতে উদ্যোগ

১৮৮৮ সালে টেসলা একটি ক্লাসিক পেপার লেখেন যেখানে তিনি তাঁর মোটর এবং বৈদ্যুতিক সিস্টেমের ধারণা প্রবর্তন করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘এ নিউ সিস্টেম অফ অল্টারনেটিং কারেন্ট মোটরস অ্যান্ড ট্রান্সফরমার্স’। তিনি শিল্পপতি ও উদ্ভাবক জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁদের অংশীদারিত্ব আমেরিকার বাকি অংশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার জন্য অংশীদার হন।

টেসলা কয়েল আবিষ্কার

১৮৯১ সালে, টেসলা একটি ইন্ডাকশন কয়েল তৈরি করেন যা উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তী প্রবাহ উৎপন্ন করত, যা এখন টেসলা কয়েল নামে পরিচিত। তিনি বৈদ্যুতিক আলো, এক্স-রে এবং ওয়্যারলেস পাওয়ার উৎপাদনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এটি ব্যবহার করেছিলেন এবং এটি রেডিও ও টিভির ভিত্তি হয়ে ওঠে। বর্তমানে, কয়েলগুলি মূলত শিক্ষামূলক প্রদর্শনী এবং বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

টেসলার বৈবাহিক জীবন

সারা জীবনে টেসলা অবিবাহিত ছিলেন, তবে একবার তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি একটি পায়রার প্রেমে পড়েছিলেন। শোনা যায়, টেসলা পার্কে পায়রাদের খাওয়াতে যেতেন। একটি সাদা পায়রার সাথে তাঁর অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পায়রাটি প্রতিদিন তাঁর কাছে উড়ে আসত। টেসলা একবার বলেছিলেন, ‘আমি সেই পায়রাটিকে একজন পুরুষের মতো ভালোবেসেছিলাম যেমন একজন মহিলাকে ভালোবাসে এবং সেও আমাকে ভালোবাসত। যতক্ষণ সে আমার কাছে ছিল ততক্ষণ আমার জীবনের একটি উদ্দেশ্য ছিল।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top