
আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে যাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তিনি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর চিন্তাশক্তি, কল্পনার গভীরতা এবং জ্ঞানের বিস্তার আমাদের ভৌত বিজ্ঞানের অনেক ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছে। শুধু বিজ্ঞান নয়, মানবতা, শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি সবসময় সক্রিয় ছিলেন। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী, বিজ্ঞানে তাঁর অসাধারণ অবদান এবং ভারত ও ভারতীয়দের সঙ্গে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
জন্ম ও শৈশবকাল
আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ, জার্মানির উলম নামক শহরে। তাঁর পরিবার ছিল ইহুদি ধর্মাবলম্বী। ছোটবেলায় আইনস্টাইন খুবই শান্ত প্রকৃতির ছিলেন এবং অনেকেই মনে করতেন তিনি বুঝি কিছুটা ধীরবুদ্ধির। কিন্তু খুব অল্প বয়সেই গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অসাধারণ আগ্রহ দেখা যায়।
বড় হয়ে তিনি সুইজারল্যান্ডের জুরিখ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট-এ পড়াশোনা করেন এবং পরে একজন পেটেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই কাজের পাশাপাশি তিনি চালিয়ে যান তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
বিজ্ঞান জগতে অবদান
আলবার্ট আইনস্টাইন সর্বাধিক পরিচিত তাঁর আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব (Theory of Relativity)-এর জন্য। ১৯০৫ সালে তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যাকে বলা হয় “চমৎকার বছর” বা Annus Mirabilis।
এই বছরেই তিনি এমন কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে:
- বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ (Special Relativity): এতে বলা হয়, সময় এবং স্থান আপেক্ষিক, এবং আলোর গতি সকল পরিস্থিতিতে ধ্রুব। এই তত্ত্বেরই অংশ হল বিখ্যাত সূত্রটি:
$E = mc^2$
অর্থাৎ, শক্তি (E) = ভর (m) × আলোর বেগ (c)²। - ব্রাউনিয়ান গতি: গ্যাসে ভাসমান অণুগুলির আন্দোলন বিশ্লেষণ করে তিনি অণুর অস্তিত্বের প্রমাণ দেন।
- ফটোইলেকট্রিক প্রভাব (Photoelectric Effect): এতে তিনি দেখান, আলো কণিকা (ফোটন) আকারে কাজ করতে পারে। এই কাজের জন্য তিনি ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (General Relativity) উপস্থাপন করেন, যেখানে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা হয় স্থান-কাল (spacetime) এর বক্রতার মাধ্যমে। এই তত্ত্ব ১৯১৯ সালে একটি সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয় এবং আলবার্ট আইনস্টাইন তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন: বিধানচন্দ্র রায় – বাংলার রূপকার হয়ে ওঠার কাহিনী
ভারতের সঙ্গে সংযোগ
আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে ভারতের কিছু উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক ছিল, যা ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ:
১৯৩০ সালে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলবার্ট আইনস্টাইনের আমন্ত্রণে তাঁর জার্মানির বাসভবনে যান। সেখানে তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে একটি গভীর আলোচনা হয়, যা আজও বিখ্যাত। এই আলোচনা “Science and the Indian Mind” নামে পরবর্তীকালে ছাপা হয়।
এই আলোচনায় আইনস্টাইন বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি সত্যের একটি চূড়ান্ত সার্বজনীন মান আছে এবং মানুষের মন স্বাধীনভাবে সেই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে।” এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সত্য, যা সর্বজনীন, তা অবশ্যই ব্যক্তিগত অনুভূতির মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে হবে।” তাঁদের এই মতপার্থক্য সত্ত্বেও, আলোচনাটি জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার এক অসাধারণ মিলনক্ষেত্র ছিল।
২. সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি সমর্থন:
যদিও আলবার্ট আইনস্টাইন সরাসরি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেখা করেননি, তবু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের অবস্থান এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতির নজির পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন চিঠিপত্রে।
৩. ডঃ চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের সঙ্গে সম্পর্ক:
রামন স্ক্যাটারিং (Raman Effect) আবিষ্কারের জন্য যিনি ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার পান, সেই ডঃ সি. ভি. রামনের গবেষণাকর্ম আইনস্টাইনও গভীর আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করতেন। তিনি একাধিক ভারতীয় বিজ্ঞানীর প্রতিভা ও মেধার প্রশংসা করেছিলেন।
৪. ডঃ এস. এন. বোস ও বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান:
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক হল ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও আইনস্টাইনের মধ্যে। ১৯২৪ সালে বোস একটি মৌলিক তত্ত্ব প্রস্তাব করেন যা পরবর্তীকালে “বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান” নামে পরিচিত হয়। আইনস্টাইন নিজে এই তত্ত্বকে আরও উন্নত করেন এবং তাঁর নাম যুক্ত করেন। এই যৌথ তত্ত্বই আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি স্থাপন করে এবং “বোসন” নামক কণার ধারণার জন্ম দেয়।
মানবতার পক্ষে আইনস্টাইন
আইনস্টাইন ছিলেন কেবলমাত্র একজন বিজ্ঞানী নন, তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী চিন্তাবিদও। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর নির্যাতনের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি চিঠিতে নিউক্লিয়ার গবেষণার গুরুত্ব জানান, যদিও পরবর্তীকালে তিনি পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের বিরোধিতা করেন।
তিনি জাতিসংঘ গঠন, বিশ্ব শান্তি, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং শিক্ষার প্রসারে সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শুধু বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তা মানব সভ্যতার উন্নয়নের পথ নির্দেশ করেছিল।
শেষ জীবন ও মৃত্যু
আইনস্টাইন জীবনের শেষভাগে “এককতত্ত্ব” (Unified Field Theory) আবিষ্কারের চেষ্টা করেন, যা মহাকর্ষ ও তড়িচ্চুম্বকত্বকে একটি তত্ত্বে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়। যদিও জীবদ্দশায় তিনি এতে সফল হননি, কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা পরবর্তী বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
তিনি ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার
আলবার্ট আইনস্টাইন শুধু একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীই নন, তিনি একান্তভাবেই একজন মানবিক মানুষ ছিলেন। তাঁর চিন্তা, গবেষণা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বিজ্ঞান ও সমাজের অনেক দিককে বদলে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্ক, বিশেষত সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।
স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্য আইনস্টাইনের জীবন কেবলমাত্র পাঠ্যবইয়ের বিষয় নয়, বরং অনুপ্রেরণার এক অবিরাম উৎস। আমাদের উচিত তাঁর কৌতূহল, অধ্যবসায় এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুসরণ করা।
জেনে রাখো:
“Imagination is more important than knowledge.” – Albert Einstein
(কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ)